‘ইজেক্ট ইমেডিয়েটলি’— এই ছিল কন্ট্রোল রুমের শেষ বার্তা। এরপর বেশ কয়েকদফায় পাইলট তৌকির ইসলাম সাগরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। যদিও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর কেটে যায় ১ মিনিটেরও কিছু বেশি সময়। সর্বশেষ বার্তা আসে ‘থর- ৫৫৫ (ছদ্ম কোড) ক্রাশড!
গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করা একটি সূত্রের তথ্য, বিধ্বস্ত হওয়ার ঠিক আগমুহূর্ত পর্যন্তও কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তৌকিরের। শেষ মুহূর্তে টাওয়ারকে জানিয়েছিলেন, এয়ারক্রাফট স্টল করেছে (এমন একটি অবস্থা— যখন বিমানের ডানা দিয়ে বাতাস সঠিকভাবে প্রবাহিত হতে ব্যর্থ হয়, ফলে উড্ডয়ন শক্তি কমে যায়, বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে)। তখন কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বলা হয়, ‘থর-৫৫৫ (ছদ্ম কোড নাম), ইজেক্ট ইমেডিয়েটলি’। এ বার্তার পর ১ মিনিটের একটু বেশি সময় পেয়েছিলেন তৌকির। কিন্তু তিনি ইজেক্ট না করে হতাহত কমাতে বিমানটি জনবহুল এলাকা এড়িয়ে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। চেষ্টা ছিল মুভ করে ঘুরানোরও। কিন্তু তাতে সফল হননি। ফাইটার জেটটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরের প্রথম একক উড্ডয়ন (সোলো ফ্লাইট) ছিল এটি।
এর আগে দুপুর ১টা ৬ মিনিটে বিমানটি কুর্মিটোলা বিআর উত্তম এ.কে. খন্দকার বিমান ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে ফাইটার জেটটি। প্রশিক্ষণ মিশনের অংশ হিসেবে এটি আকাশে চক্কর দিতে থাকে। উড্ডয়নের পর কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে তার অবস্থান জানাতে বলা হয়। তৌকির অবস্থান নিশ্চিত করেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তৌকিরকে দ্বিতীয় দফায় তার অবস্থান জানাতে বলা হয়। এ সময়ই পাইলট (তৌকির) তার অবস্থান জানিয়ে বলেন, এয়ারক্রাফট স্টলড।
এরপর কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে তাকে ঘাঁটিতে ফিরে আসার চেষ্টা করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ সময় তখন তৌকির আবারও বিমানের অবস্থান জানায়। এ সময় বিমানটি দ্রুত উচ্চতা হারাতে থাকলে পরের নির্দেশনায় তৌকিরকে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বলা হয়, ‘ইজেক্ট!’ কিন্তু তৌকির ইজেক্ট না করে বিমানটিকে মুভ করার চেষ্টা করেন। চেষ্টা ছিল উত্তরার দিয়াবাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের দোতলায় গিয়ে বিধ্বস্ত হয়।
বিমানের এক কর্মকর্তা জানান, যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা ফ্লাইং অবস্থায় না থাকলে ফাইটার জেট এক ধরনের স্টোনে রূপ নেয়। তখন চাইলেও সাধারণভাবে এর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ওপর থেকে দ্রুতগতিতে নিচে পড়ে যায়।
নাম প্রকাশ করার শর্ত দিয়ে বাংলাদেশ বিমানের এক পাইলট গণমাধ্যমকে জানান, কন্ট্রোল অফিস থেকে যদি বলা হয়েই থাকে ইজেক্ট! তবে তিনি যদি সেটা করতেনও, তাতে কী হত! পাইলট তৌকির কি বাঁচতেন নাকি ক্ষয়ক্ষতি কম হত। হয়তো এর কিছুই না। কারণ এর আগে স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ জরুরি প্যারাসুট দিয়ে অবতরণ করেও তো বাঁচেননি।
কন্ট্রোল রুমে শেষবারের মতো যোগাযোগে বলা ‘বিমান ভাসছে না… মনে হচ্ছে নিচে পড়ছে’— গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরের বিষয়ে তিনি বলেন, কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সাধারণত বাংলায় এ ধরনের কথা হয় না। হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই কম। পত্রিকা-অনলাইন কোথা থেকে এই সংবাদ পেলেন, সেটাই তারাই ভালো বলতে পারেন।
বিমান বন্দরের আশেপাশের জায়গা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এই পাইলট বলেন, বিমান উড্ডয়নের সুবিধার্থে বিমানবন্দর এলাকার আশেপাশে বহুতল ভবন তৈরিতে ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেছিল সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেটা কি বাস্তবায়ন হয়েছে? হয়নি; বরং আরও বেড়েছে।
তথ্যমতে, প্রথম সলো ফ্লাইট ট্রেনিং মূলত প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শেষ ধাপ; যেখানে একজন শিক্ষার্থী পাইলট প্রথমবারের মতো প্রশিক্ষক ছাড়াই একা বিমান উড্ডয়ন করে থাকেন। এটি একজন পাইলটের দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত প্রমাণ।
তৌকির ইসলাম রাজশাহী গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল এবং পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন। ২০১৭ সালে বিএএফে যোগদান করেন তিনি। তার স্ত্রী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারার। তৌকিরের পরিবার রাজশাহীতে থাকেন।
প্রশিক্ষণ বিমান নাকি যুদ্ধবিমান?
সূত্রের তথ্য, বাংলাদেশে দুই ধরনের যুদ্ধ বিমান রয়েছে। এক. মিগ-২৯ এবং দুই. এফ-৭ বিজিআই। মিগ-২৯ তুলনামূলকভাবে পুরোনো হলেও এটি সর্ব-আবহাওয়া (অল-ওয়েদার) অপারেশনের জন্য সক্ষম। অন্যদিকে, এফ-৭ বিজিআই নতুন প্রজন্মের বিমান, যদিও এটি শুধু দিনের আলোতে (ডেলাইট) অপারেশনের জন্য উপযুক্ত।
সূত্রের তথ্য, বাংলাদেশে মিগ-২৯ এর ফ্লিট অফ ৮ আছে বলা হলেও অপারেশনাল মাত্র দু’টি। অন্যদিকে ৩৫টি এফ-৭ এর মধ্যে অপারেশনাল ৩২টি। এই দুই ধরনের এয়ারক্রাফটেই ট্রেনিং সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট বিমানের অপারেশনাল পাইলট হন (অন্য বিমান থাকলেও কাউকে যদি এই বিমানের অপারেশনাল পাইলট হতে হয়, তাকে এই বিমানের সকল ট্রেনিং মিশন সম্পন্ন করতে হবে)।
বিমান বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, এফ-৭ বিজিআই প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ বিমান হিসেবে ক্রয় করা হলেও, যুদ্ধাবস্থায় এটি দেশের প্রধান ডেলাইট ইন্টারসেপ্টর হিসেবে কাজ করবে। এই বিমানগুলোর মাধ্যমে বিমান বাহিনীর পাইলটরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ মিশন সম্পন্ন করে অপারেশনাল ফাইটার পাইলট হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেন।
বিমান বাহিনীর সূত্র জানায়, যুদ্ধ মিশন ব্যতীত প্রায় সকল ফ্লাইটই প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
২৯ শিশু, দুই শিক্ষক ও পাইলটসহ নিহত ৩২: এফটি-৭ বিজিআই ফাইটার জেট বিধ্বস্ত হয়ে ইতোমধ্যেই কমপক্ষে ৩২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে ২৯ জন শিশু, দুজন শিক্ষক এবং পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম রয়েছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৭০ জন, যাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দুর্ঘটনায় নিহত শিশুদের মধ্যে রয়েছে নাফি ইসলাম (৯), মাইলস্টোনের রসায়নের সহকারী অধ্যাপক ইউসুফের ছেলে সায়ান ইউসুফ (১৪, সপ্তম শ্রেণি), বাপ্পি (৯), এরিকসন (১৩), অ্যারিয়ান (১৩), নাজিয়া সহ (১৪) অনেকে। শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন মাসুকা ও মেহেরিন। এ ঘটনায় শিক্ষিকা মেহেরিন চৌধুরী (৪৬) সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ২০ জন শিক্ষার্থীকে বাঁচিয়েছেন, কিন্তু নিজেও দগ্ধ হয়েছেন এবং পরে তিনিও বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১৭০ জন আহতের মধ্যে অনেকেই বার্ন ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য হাসপাতালে গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন।
খুলনা গেজেট/এএজে